বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৭ অপরাহ্ন

সড়কে লাখ লাখ ‘চলন্ত বোমা’

সড়কে লাখ লাখ ‘চলন্ত বোমা’

স্বদেশ ডেস্ক:

রাজধানী ঢাকায় বিশ্বমানের বার্ন ইউনিট থাকার পরও দগ্ধ রোগীদের বাঁচানো যাচ্ছে না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। চিকিৎসকরা বলছেন, বিস্ফোরণের পর সিলিন্ডারের বিষাক্ত জ্বলন্ত টুকরোগুলো মানবদেহের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। বিষাক্ত ধোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত করছে ফুসফুস, পুড়ে যাচ্ছে শ্বাসনালি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই টুকরোগুলো বের করা কঠিন হয়ে পড়ায় রোগীদের বাঁচানো সম্ভব হয় না।

সূত্র বলছে, সড়কে চলন্ত সিলিন্ডারগুলোর প্রায় ৮০ ভাগই পুনঃপরীক্ষার বাইরে। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো পেটের মধ্যে ফিটনেসবিহীন গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে রাজপথ-মহাসড়ক। সিএনজিচালিত বেশির ভাগ গাড়িই যেন একেকটি ‘চলন্ত বোমা’। বাসাবাড়ি, ছোট-বড় দোকান এবং বিভিন্ন কারখানায় অবাধে চলছে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার। যত্রতত্র গড়ে ওঠা কারখানাগুলোয় অসচেতন দরিদ্র শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই নিরীহরাই এই বিস্ফোরণের শিকার হচ্ছেন। যারা বেঁচে যাচ্ছেন, তাদের অনেককেই পঙ্গুত্ববরণ করতে হচ্ছে।

আগুন নিয়ে কবি রাজাত হুগোর একটি বিখ্যাত পঙ্ক্তি রয়েছে- ‘এ রাষ্ট্র আগুন পোষে। যেমন আমি আগুন পুষি বুকে-আমার আগুন জ্বলে বিদ্রোহে।’ রাষ্ট্রের পোষা আগুনে প্রতিনিয়ত সড়ক, রেস্টুরেন্ট ও যত্রতত্র গড়ে ওঠা কারখানায় দগ্ধ হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এই অগ্নিকাণ্ড।

অতিসম্প্রতি কেরানীগঞ্জের একটি প্লাস্টিক কারখানায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে রোববার দুপুর পর্যন্ত অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে আরও অন্তত ১৫ জন। এদের বেশির ভাগই মৃত্যুঝুঁকিতে আছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য বলছে, গত বছর ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিভাগেই ১০৩টি গ্যাস দুর্ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে গ্যাসলাইনের ছিদ্র থেকে ৫৫টি ও গ্যাস সিলিন্ডার থেকে ৪৮টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে শিশুসহ ৬ জন, হাসপাতালে ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

চিকিৎসাধীন অবস্থায় এত দগ্ধ রোগীর মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম বলেন, নতুন এই বার্ন ইউনিটে মানের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বার্ন ইউনিটের সমান। তবে সিলিন্ডারের জ্বলন্ত টুকরাগুলো দগ্ধ শরীরে দ্রুত ঢুকে গিয়ে জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। এসব কারণেই দগ্ধ রোগীদের বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন যুগান্তরকে জানান, বছরে সারা দেশে প্রায় সাত লাখ মানুষ অগ্নিকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ দগ্ধ ব্যক্তি ঢাকার বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নেয়। বড় অগ্নিকাণ্ড মানেই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। এ ধরনের বিস্ফোরণে দগ্ধদের বাঁচানো সম্ভব হয় না। আগুনের তীব্রতা বেশি হওয়া এবং বিস্ফোরণের পর জলন্ত টুকরো ও বিষাক্ত ভারি ধোঁয়া ফুসফুসে ঢুকে পড়ে। এতে শ্বাসনালি ও ফুসফুস পুড়ে যায়। এ অবস্থায় সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিয়েও অনেককে বাঁচাতে পারিনি। যারা বেঁচে যান, তাদেরকে আজীবন পুঙ্গু হয়েই থাকতে হয়। শীতে এই রোগীর সংখ্যা বাড়ে।

কথা হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, গ্যাস সিলিন্ডার নয়, এ যেন একেকটি শক্তিশালী ‘বোমা’। এগুলো অরক্ষিত ও অনিরাপদ। রাজধানীসহ দেশের সর্বত্রই এগুলোর বিচরণ। কারখানা, যানবাহন, এমনকি ঘরের অন্দরমহলেও এই ‘বোমা’ রয়েছে। বেশির ভাগেরই মেয়াদ নেই। বিস্ফোরণ ঘটলে এগুলো ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। তিনি বলেন, প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। এখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা ব্যাপক। সর্বস্তরের লোকজনের মধ্যে সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ না এলে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। ফায়ার সার্ভিস বলছে, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ২০১৭ সালে ৭৯, ২০১৬ সালে ১৩১ ও ২০১৫ সালে ৮০টি দুর্ঘটনা ঘটে। মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন গ্যাস সিলিন্ডার পরিণত হয়েছে এক একটি ‘চলন্ত বোমা’য়। গত ১০ বছরে ছোট-বড় প্রায় ১০ হাজার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এতে প্রাণ গেছে ১ হাজার ৫৯০ জনের।

বিস্ফোরক অধিদফতর বলছে, প্রতিটি গ্যাস সিলিন্ডারের আয়ু ১০-১৫ বছর। এরপর এগুলো বাতিল করতে হয়। নির্ধারিত সময় পর সিলিন্ডারগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ঝুঁকি নিয়েই মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির ভেতরে মেয়াদোত্তীর্ণ এসব সিলিন্ডার সড়ক দাবড়ে বেড়াচ্ছে। সূত্র বলছে, এসব অনিয়ম দেখার জন্য বিস্ফোরক অধিদফতরের নির্ধারিত পরিদর্শক রয়েছে। কিন্তু তারা দায়িত্ব পালন করছে না ঠিকভাবে, এসব নিয়ে নানা অভিযোগ আছে। ২০১৬ সালে বিস্ফোরক অধিদফতর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের ১১ হাজার গ্যাস সিলিন্ডার পরীক্ষা করে ৮ হাজারই ব্যবহারের অনুপযোগী পায়। পরে সেগুলো বাতিল করা হয়। অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিকভাবে প্রায় ৯০ লাখ এলপিজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) সিলিন্ডার আছে। গাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার আছে প্রায় ৪ লাখ। এসব সিলিন্ডার পুনঃপরীক্ষার পর্যাপ্ত সুবিধাও দেশে নেই। সারাদেশে মাত্র ১৫টি পুনঃপরীক্ষা কেন্দ্র রয়েছে।

তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, মালিক, প্রশাসনের দায়িত্বহীনতার কারণেই একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। প্রশাসনই বলছে, কেরানীগঞ্জ প্লাস্টিক কারাখানাটি অবৈধ। এর লাইসেন্স ছিল না। তাহলে ২ বছর ধরে এটি কী করে চলেছে। এর উত্তর কে দেবে। এজন্য মন্ত্রী, আমলা থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন দায়ী, তাদেরও বিচার হওয়া উচিত। তিনি বলেন, এমন দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছেন, তাদেরকে গড় আয়ু হিসাব করে দ্বিগুণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি দিতে হবে। মালিকপক্ষের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাদের ক্ষয়ক্ষতি দিতে হবে।

ঢাকাবাসী যে কতটা অগ্নিঝুঁকিতে আছে, এর বড় প্রমাণ হচ্ছে এই উদাহরণটি- সরকার নতুন করে গ্যাস সংযোগ না দেয়ায় এই ঢাকা শহরেরই এক বাড়ির মালিক নিজ উদ্যোগে ভবনের নিচ তলা থেকে পাইপে প্রতি ফ্ল্যাটে গ্যাস সরবরাহ করছেন। নিচ তলায় গ্যাস সিলিন্ডারগুলো জড়ো করে পাইপের মাধ্যমে প্রতি ফ্ল্যাটে গ্যাস সরবরাহ করছেন। যদি কোনো কারণে একটি সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটে, তাহলে বাকি সিলিন্ডারগুলোয়ও বিস্ফোরণ ঘটার শঙ্কা রয়েছে।

২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজার চুড়িহাট্টায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৮১ জন নিহত হন। এরপরও খেলনার মতো ব্যবহার হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। ৩০ অক্টোবর রূপনগর আবাসিক এলাকায় গ্যাস বেলুন বিক্রির সময় বিস্ফোরণে ৭ শিশু নিহত হয়। মে মাসে গাজীপুরের ইসলামপুরে গ্যাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একই পরিবারের চারজন নিহত হন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877